মানুষের ইতিহাসে যন্ত্র উদ্ভাবন এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির বিকাশ এবং তার ফলে সামাজিক পরিবর্তন বারবার ঘটেছে। প্রাগৈতিহাসিক অতীতে চাকার উদ্ভাবন পরিবহনে বিপ্লব এনে সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের উদ্ভাবন শিল্পবিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল, ট্রানজিস্টর তৈরির সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক ইলেকট্রনিক্স ও কম্পিউটার যুগের সূচনা। অণুবীক্ষণ যন্ত্র চিকিৎসা শাস্ত্র, জীববিদ্যা ও পরে পদার্থবিজ্ঞানে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। দূরবিন এমন কোনো যন্ত্র নয় যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খুব বেশি ব্যবহৃত হয়। জ্যোতির্বিদ্যাতে আমরা সাধারণত যে সমস্ত বস্তু পর্যবেক্ষণ করি তা আমাদের নাগালের অনেক বাইরে। তাহলে হঠাৎ দূরবিন নিয়ে একটা আস্ত বই লেখার কী প্রয়োজন?
দূরবিন হল এমন এক উদ্ভাবন যা তার সভ্যতার বিকাশের ধারাকে পাল্টে দিয়েছে। আমরা বলে থাকি সপ্তদশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। অবশ্য বিপ্লব কথাটাতে কোনো কোনো বিজ্ঞানের ঐতিহাসিকের আপত্তি আছে, তাঁরা মনে করেন যে সপ্তদশ শতাব্দীর বিজ্ঞান তার আগের যুগের ধারাবাহিক উন্নতির ফল। কিন্তু বিশেষ করে বিজ্ঞানীদের এক বড় অংশই মনে করেন যে দূরবিন আবিষ্কার এবং তাই দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ বিজ্ঞানের জগতে এক বড় পরিবর্তন এনেছিল। অবশ্যই সেই পরিবর্তনের পথ তার আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল, কিন্তু তাকে ত্বরান্বিত করেছিল দূরবিন। আমরা বুঝেছিলাম চোখে যা দেখতে পাই, তার বাইরে রয়েছে এক বিরাট বিশ্ব। শুধু তাই নয় দূরবিন আমাদের পর্যবেক্ষণ, বহুদিনের সযত্নলালিত বিশ্বাস এবং সাধারণ বুদ্ধিকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিল — এই প্রশ্ন ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম হত না, পরবর্তীকালের প্রযুক্তির বিকাশও সম্ভব ছিল না। এক কথায় বলতে গেলে মধ্যযুগের সমাপ্তি ঘটিয়ে আধুনিক যুগের সূচনা করেছিল ওই যন্ত্রটি।
দূরবিন আবিষ্কারের পর চারশো বছর পেরিয়ে গেছে। 2021 সালের 18 ডিসেম্বর আকাশে ওড়ার কথা জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের। প্রথম দূরবিন যাঁরা বানিয়েছিলেন, তাঁরা আজকের দানবাকৃতি যন্ত্রদের চিনতে পারবেন না। রেডিয়ো টেলিস্কোপ বা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ ডিটেক্টর তাঁদের কাছে অবোধ্য ঠেকত। কিন্তু তাঁদের উদ্ভাবনটিই যুগে যুগে নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। একই সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আমাদের ধারণার বহু পরিবর্তন সে করেছে। এই বই সেই দুই পরষ্পর সংযুক্ত পরিবর্তনের কাহিনি। তবে এ বই জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাস নয়, দূরবিনের গল্প। গত চারশো বছরে জ্যোতির্বিদ্যার নানা ঘটনার মধ্যে মাত্র কয়েকটাই এখানে পাওয়া যাবে, তবে অধিকাংশ মূল অগ্রগতিই স্থান পেয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। দূরবিনের গল্প লিখতে বসলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কথা আসা স্বাভাবিক। তার মধ্যে যেগুলো আমাদের কাহিনির মূলসূত্র অনুসরণ করার জন্য খুব প্রয়োজনীয় নয়, তবে উৎসাহীদের ভালো লাগতে পারে, তাদের নিয়ে কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা পরিশিষ্টে সংযোজন করা হয়েছে।
দূরবিন শুধু দূরেই দেখে তা নয়, অতীতের দিকেও দৃষ্টিপাত করে। সহস্র কোটি আলোকবর্ষ দূরের যে গ্যালাক্সির আলো আজ আমাদের দূরবিনে ধরা দিল, সে যখন যাত্রা শুরু করেছিল তখন সূর্যের সৃষ্টি হয়নি। সুদূর সেই অতীতে দৃষ্টিপাতের উপযোগী আরো কিছু যন্ত্র আছে যাদের চেহারা আমাদের পরিচিত দূরবিনের সঙ্গে মেলানো যাবে না। কিন্তু তারাও দূরবিন, তাই তাদের কারো কারো কথা এই বইতে আছে।