আলমগীর বাদশা আওরঙ্গজেব এর মৃত্যু মুঘল সাম্রাজ্যের শীর্ষবিন্দু। মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এতদূর কখন ও পৌঁছয়নি। পার্বত্য মুষিক শিবাজীর মৃত্যুর পর বাদশার হাতে মারাঠা শক্তি কোনঠাসা। শিবাজী পুত্রের নিষ্ঠুর মৃত্যু হয়েছে মুঘলদের হাতে। শিবাজীর পৌত্র মুঘল কারাগারে বন্দী। দাক্ষিণাত্যের সুলতানী রাজ্যগুলি মুঘলদের অধীনে এসেছে। সারা ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল শক্তি নিরঙ্কুশ। তবুও প্রদীপের এই উজ্জ্বল শিখার নিচে এক জমাট অন্ধকার যেন ঘনিয়ে এসেছিলো যা মহীরুহের পতনের অব্যবহিত পরেই সারা উপমহাদেশের আকাশে ছেয়ে যাবে।
সবচেয়ে প্রতাপশালী সম্রাটের পর একের পর এক অযোগ্য অকর্মন্য শাসক বসতে থাকল মুঘল তখতে। আসল ক্ষমতা চলে গেল কিছু সুযোগসন্ধানী উমরাহদের হাতে। তাদের ইঙ্গিতেই বাদশা সিংহাসনে বসে সিংহাসনচূত হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের স্থানে স্থানে সুবেদাররা স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকে। হায়দরাবাদে নিজাম, আওধ এ সফদর জঙ্গ ও তার ছেলে সুজা উদ দৌলা। গঙ্গা যমুনার মধ্যবর্তী দোয়াব এ আফগান রোহিলাদের আধিপত্য। দুর্বল মুঘল বাদশাকে কেউ বিশেষ পাত্তা দেয় না। শিখরা জেগে উঠেছে পাঞ্জাবে। ইরানী বাদশা নাদির শাহ ও তার মন্ত্রশিষ্য আফগানী আহমদ শাহ আবদালী বারবার হিন্দুস্থানে হামলা করছে। লুটপাট আর খুন জখমেই আগ্রহ তাদের। মুঘলদের মতো শাসক হবার কোনো বাসনা তাদের নেই। সুযোগসন্ধানী ফিরিঙ্গিরাও খুব একটা পিছিয়ে নেই।ঘোলা জলে মাছ ধরার স্থির লক্ষ্য তাদের। এদের মধ্যে অগ্রণী ইংরেজরা। আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ প্রদেশ বাংলায় ক্ষমতা দখল করল তারা। বণিকের মানদন্ড দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে। অচিরেই “সব লাল হো যায়েগা”। এ সবের মাঝে মারাঠা শক্তি কিন্তু এবার জেগে উঠল নতুন উদ্যমে। আওরঙ্গজেব এর মৃত্যুর পর মুঘল শাসনের রাশ আলগা হতেই নিজেদের হারানো জমি ফিরে পেতে উদ্যোগী হল তারা। শাহু রাজা নামমাত্র। আসল ক্ষমতা পেশোয়াদের হাতে। ঊষাকালে বালাজি বিশ্বনাথ, পূর্বাহ্নে বাজিরাও আর মধ্যাহ্নে বালাজি বাজিরাও। মধ্যাহ্নের সেই তপ্ত প্রহরে মারাঠা সূর্যের প্রখর আলোয় সম্পূর্ণ ভারতভূমি আলোকিত। বঙ্গোপসাগর থেকে সিন্ধুনদ-কটক থেকে আটক মারাঠাশক্তির অধীন। সমস্ত আঞ্চলিক শক্তি পর্যুদস্ত। মুঘল সম্রাট মারাঠাদের হাতের পুতুল। নিজের স্বার্থে ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে দোয়াবের আফগান সর্দার নজিব শরণ নিল আফগান বাদশা আহমদ শাহ আবদালীর। সঙ্গে যোগ দিল দোয়াবের অন্য রোহিলা সর্দাররা। আওধ এর নবাব সুজা উদ দৌলাও সঙ্গ দিলো নজিবের। মারাঠাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ রাজপুত আর জাঠরা থাকলো নিরপেক্ষ। সম্পূর্ণ বান্ধবহীন মারাঠারা পানিপথ এর প্রান্তরে সম্মুখীন হল আবদালী আর তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে(১৭৬১)। সে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ।অষ্টাদশ শতাব্দীর সবথেকে লোকক্ষয়ী যুদ্ধ। যোগ্যতর নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা, উন্নত অস্ত্র সর্বোপরি সংখ্যাধিক্ষর জোরে আবদালীর জয় হলো। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে মৃত্যু বরণ করল একের পর এক মারাঠাবীর।
মারাঠাদের হিন্দু রাজত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সার্থক হল না।