খুন জিনিসটার কথা ভাবামাত্র আমাদের চোখের সামনে দুটো রঙ ফুটে ওঠে--- রক্তের লাল, আর অপরাধের সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে জড়িয়ে থাকা কালো। কিন্তু এই বিশেষ অপরাধটির সঙ্গে যতরকমের কার্যকারণ জড়িয়ে থাকে, আর তার ফলাফলও যতরকমের হয়, তা তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ব্যাপারটা মোটেই সহজ নয়। এই প্রক্রিয়াটিতে আরও একটি রঙ আছে, সে আমরা মানি বা না-মানি।
প্রথমে আসা যাক মোটিভ বা হত্যার কারণের কথায়। খুন যে একটা অপরাধ, এই নিয়ে কোনো সংশয় থাকতে পারে না। কিন্তু অপরাধের পেছনে যা-যা থাকে সেগুলো বিচার করলে ব্যাপারটা ক্রমে জটিল হয়ে ওঠে। আইনের সাদা আর বেআইনের কালোর মধ্যে থাকা আপাত-স্পষ্ট বিভাজিকাটা ক্রমেই আবছা হয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রে। বহু ক্ষেত্রেই সেই কারণগুলো জানার পর আমাদের সহানুভূতি থাকে অপরাধীর দিকেই।
এবার আসা যাক মোডাস অপারেন্ডাই বা হত্যাপদ্ধতির ব্যাপারে। বাস্তবানুগ কাঠামোয় আইনরক্ষক ও বিচারব্যবস্থা অপরাধীদের দোষী হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়। তার ভিত্তি থাকে পুলিশি অনুসন্ধান, যার ফরেনসিক ও অন্য পদ্ধতিগত খুঁটিনাটিগুলো আমাদের আকর্ষণ করে প্রবলভাবে। সেই অনুসন্ধানের একটা বড়ো অংশ থাকে হত্যার প্রতিটি ধাপ বোঝার মধ্যে। তার মাধ্যমেই একে-একে চিহ্নিত হয় হত্যার সময়, উপকরণ, কীভাবে খুনটা হয়েছিল, ইত্যাদি। কিন্তু এই সময় আরও একবার পাঠক হিসেবে আমরা প্রবলভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আমাদের মনে হয়, খুনটা বোধহয় পূর্বপরিকল্পিত বা প্রি-মেডিটেটেড ছিল না। ওইরকম পরিস্থিতিতে অনেক কিছুই হতে পারে। এমনকি আমরাও হয়তো...!
এই সংশয়ের জায়গায় পৌঁছোলেই আমাদের কাছে খুন ব্যাপারটা কেমন যেন একটা ঘোলাটে আয়নার মতো হয়ে উঠতে থাকে। সেই অবস্থাটা আরও জোরালো হয় পোস্ট-মর্টেম এবং ফরেন্সিকের নানা খুঁটিনাটি জানার মধ্য দিয়েও। পুলিশ বা রহস্যভেদীর বদলে আমরা নিজেদের ওই নিহত ব্যক্তির অবস্থানে ফেলে দেখতে থাকি। তখনই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। আমরা একটু-একটু করে হত্যাকারীকে বুঝতে শুরু করি।
হত্যার সময়টা একবার চিহ্নিত হয়ে গেলে তখন শুরু হয় হত্যার উৎস সন্ধানের তথা হত্যাকারী চিহ্নিতকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ---অপরচুনিটি বা সুযোগ! খুন করতে হয়তো অনেকেই চায়। কিন্তু ওই বিশেষ সময়টাতে তাদের মধ্যে কে-কে খুন করার মতো অবস্থায় ছিল? এই অপরচুনিটি বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই বেরিয়ে আসতে থাকে অনেক লুকোনো কথা, অনেক অকথিত সত্য। আর তাদের পড়তে গিয়ে, বুঝতে গিয়ে আরও একবার আমাদের মনে হয়, অপরাধী ছাড়া পেয়ে গেলেই বোধহয় ভালো। না হয় পুলিশ এবার ভুলই করুক!
কিন্তু আইন এগিয়ে চলে নিজের পথে নিজের মতো করে। তার উজ্জ্বল আলোয় ধরা পড়ে সবকিছু, আজ হোক বা কাল। সে আপাতভাবে অসম্ভব কোনো খুন হোক (লকড রুম মার্ডার), বা আপাতভাবে দুর্ঘটনার মিছিল, পুলিশ বা সত্যসন্ধানী এক না একদিন সত্যিটা জেনেই ফেলে। কিন্তু তারপর কী হয়?
হত্যা নামক ক্রিয়াটি আপাতভাবে তমোগুণাত্মক, ভারী, বিষাদাচ্ছন্ন, কালো। সেটি সম্পন্ন করার পরেও হত্যাকারীর মানসিক অবস্থা সম্পূর্ণভাবে সুস্থিত হয় না। তার কারণ একটিই। হত্যার যুক্তি হিসেবে সে নিজের ও অন্যদের কাছে যতই তক্কো আর গপ্পো পেশ করুক, তার নিজের রজোগুণাত্মক তথা একটি কাজকে সম্পন্ন করার প্রবৃত্তিই যে সেই কাজটি করতে, এমনকি বিবেকের বা অন্য সব বাধা পেরোতে তাকে বাধ্য করেছে, এটা সে নিজের কাছে কিছুতেই লুকোতে পারে না। আর তখনই আসে তার নিজের সত্ত্ব বা শুদ্ধভাবের সঙ্গে এই উপলব্ধির সংঘাত। এই সাদা রংটাই ক্রমশ তার মনের মধ্যে এতক্ষণ চলা নানা হিসেব-নিকেশ গোলমাল করে দিতে থাকে।
তখন সে কী করে? এরপর তাকে নিয়ে আমরাই বা কী করি?
সেটা জানতে ও বুঝতে গেলে আপনাকে এই বইয়ের তিনটি উপন্যাসোপম বড়ো গল্প পড়তে হবে।
অনিরুদ্ধ সাউ আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক। আজ অবধি সে যেখানে যা লিখেছে, মোটামুটি সবই আমি পড়েছি। তার কারণটি অত্যন্ত সহজ। বাংলায় পুলিশ প্রোসিডিওরাল অনিরুদ্ধের মতো এত ভালোভাবে কেউ লিখতে পারে না। কিন্তু শুধুমাত্র পদ্ধতির খুঁটিনাটিতেই সে মেতে থাকে না। বরং নিহত ও হত্যাকারীর মনের মধ্যে যে আলো-অন্ধকারের খেলা চলে, যে অদ্ভুত রক্তাক্ত নকশা ফুটে ওঠে তাদের সেই খেলার পরিণামে, অনিরুদ্ধ সেগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরতেই বেশি আগ্রহী হয়। হয়তো সেজন্যই তার লেখা এই রহস্যকাহিনিরা নিছক হু-ডান-ইট বা হাউ-ডান-ইট থাকে না। তারা হয়ে ওঠে খুনের সত্ত্ব, রজ, তম--- এই তিনগুণের বিচিত্র বিন্যাস ফুটিয়ে তোলার এক মাধ্যম।
এই বইয়ের তিনটি কাহিনিতেও আছে হত্যার এই তিনটি গুণের অদ্ভুত প্রকাশ। তারা জটিল, গতিময়, নির্মম, আবার মর্মস্পর্শীও বটে। তাদের পড়ার পর খুনখারাপির ব্যাপারটা হয়তো আপনাদের চোখেও একটু অন্যরকম ঠেকবে।
আর আপনাদের দেরি করাব না। পাতা ওল্টান এবং ঝাঁপ দিন হত্যার ত্রিগুণে। পরে আবার কথা হবে, কেমন?